সানজিদ মাহমুদ সুজন, জেলা প্রতিনিধি:জাজিরা (শরীয়তপুর):
গত বৃহস্পতিবার (০৮-সেপ্টেম্বর) রাত প্রায় বারোটা। হঠাৎ করে ঢাকা মেট্রো-চ এর ৫১-৩৭৭ নম্বরের একটি বেগুনি সিলভার রংয়ের নোহা মাইক্রোবাস এসে থামে শরীয়তপুরের জাজিরার সেনের ইউনিয়নের চরধুপুরিয়া মোল্লা কান্দি গ্রামের বাসিন্দা মুদি ব্যবসায়ী মোঃ রিপন মোল্লার বাড়ির সামনে।
গাড়ি থেকে নেমে আসে একই এলাকার ইউপি সদস্য আইয়ুম মোল্লার ছেলে জসিম মোল্লা। তার সাথে আসে আরও প্রায় ১০-১৫ জন সহযোগী। রিপনের সাথে তার তেমন কোন বিশেষ ঝামেলা নেই। তাই এসে রিপনকে প্রথমে ছালাম দেয় জসিম মোল্লা। এরপর রিপনের মোবাইল দিয়ে একজনকে কল দিয়ে ডেকে আনতে বলে রিপনকে। রিপন তাতে অস্বীকৃতি জানায়।
যার ফলে রিপনের সাথে জসিমের কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে সব স্বাভাবিক হয়ে যায়। এরপর জসিম রিপনকে বলে আমার একটু রক্ত দেখতে ইচ্ছে করছে। এই কথা বলেই রিপনের হাতে থাকা ধারালো ছুড়ি দিয়ে একটি কোপ মারে জসিম। যার ফলে কেটে যায় জসিমের হাতের কিছু অংশ। রিপন চিৎকার দিয়ে উঠলে সাথে সাথে জসিম ও তার সহযোগীরা তাদের হাতে থাকা ধারালো ছুরি দিয়ে এলোপাথারিভাবে রিপনকে কুপিয়ে জখম করে শরীরের বিভিন্ন জায়গায়। একটি আঘাত রিপনের বুকে লাগে, যার ফলে রিপনের ফুসফুস, কলিজা ও লিভারসহ কেটে যায় পাজরের একটি হাড়।
এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কেপে কেপে উঠছিলেন, গত রবিবার (১১-সেপ্টেম্বর) রাতে ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া মোঃ রিপন মোল্লা(৩৭) এর আপন ভাই প্রত্যক্ষদর্শী সবুজ মোল্লা। কারণ জসিম ডাকাত তাদের কাছে একটি ত্রাসের নাম, একটি আতঙ্কের নাম।
এখানেই শেষ নয়, এরপর নোহা গাড়িটি চলে যায় কাজীরহাট বাজারের পাশে ডুবিসায়বর এলাকার মোঃ শামসুল হক কাজীর ছেলে ব্যবসায়ী কাজী সুলতান মাহমুদের বাড়িতে। উদ্দেশ্য ব্যবসায়ী সুলতান কাজীকে খুন করা। বাড়িতে গিয়ে সুলতান কাজীকে না পেয়ে কয়েকটি বসতঘরে হামলা চালিয়ে বাড়িতে থাকা লোকজনকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে শুরু করে ডাকাতি।বেশ কিছু স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ অর্থ নিয়ে দুইটি বসতঘর থেকে। এসময় সুলতান কাজীর চাচা দানেশ কাজী ডাকাত জসিমকে তাদের বাড়িতে ডাকাতি না করার অনুরোধ জানানোয় একটি ধারালো চাপাতি দিয়ে কোপ মারে ডাকাত জসিম। যার ফলে কেটে ও ভেংগে যায় দানেশ কাজীর, হাতের কব্জির বেশ অংশ।
ডাকাত জসিমের হাতে আহত দুজনকেই পরে জাজিরা উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সে নিয়ে এসে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার পরে দানেশ কাজীর অবস্থা কিছুটা উন্নতি হলেও মারা যায় মোঃ রিপন মোল্লা।
খবর পেয়ে পুলিশ সিলভার কালারের নোহা গাড়িটির পিছু নিয়ে গাড়িটিকে বিকে নগর কলেজ মোড় এলাকা থেকে ড্রাইভার রাজিবন শরিফ(৩৪)
সহ আটক করতে সক্ষম হয়। সেই সাথে নিলয় মাতুব্বর(২৩)
আরেক ডাকাতকেও আটক করে পুলিশ। তবে ডাকাত সরদার জসিমসহ বাকিরা পালিয়ে যায়। এসময় গাড়িতে থাকা দুটি রামদা ও একটি চাপাতি উদ্ধার করে পুলিশ।
এদিকে এই ঘটনায় জাজিরা থানায় তিনটি মামলা হয়েছে। একটি হত্যাচেষ্টা মামলা করেছে নিহত রিপনের স্ত্রী রুমা আক্তার(৩২), যার মামলা নং-১২/২০২২। ১১-সেপ্টেম্বর আরেকটি হত্যাচেষ্টা ও মালামাল চুরির মামলা করেছে কাজী সুলতান মাহমুদ(৪৭), যার মামলা নং- ১০/২১৯ এবং ৯-সেপ্টেম্বর জাজিরা থানার পুলিশ উপ-পরিদর্শক(এসআই) মোঃ বোরহান দর্জি বাদী হয়ে ৭/২১৬ নংয়ের একটি অস্ত্র মামলা দায়ের করেন।
অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে এক লোমহর্ষক কাহিনি। জসিমের সাথে বেশিরভাগ সময়ই বিভিন্ন দেশী-বিদেশী অস্ত্র থাকে। যার ফকে সবাই তাকে ভয় পায়। ডাকাত জসিম মোল্লার বিরুদ্ধে জাজিরা থানাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় বিভিন্ন সময়ের প্রায় ১৩টি মামলা রয়েছে। যার মধ্যে মাদক, চাঁদাবাজি, খুন, ডাকাতি, অস্ত্রবাজী ও নারী নির্যাতনসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। যার মধ্যে কয়েকটিতে হয়েছে সাজা এবং কয়েকটির অভিযোগ প্রমাণিত।
এছাড়া তার বিরুদ্ধে রয়েছে অস্ত্রের মুখে মানুষকে জিম্মি করে চাঁদা আদায়সহ অসংখ্য অভিযোগ। স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, ডাকাত জসিম দেশে আসার খবর পেলেই জাজিরার কাজীরহাট এলাকা থেকে সেনেরচর পর্যন্ত সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী এমনকি জনপ্রতিনিধিরা পর্যন্ত আতঙ্কে থাকে। কখন কাকে কোথায় ধরে চাঁদা দাবী করবে অথবা মেরে ফেলবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই।
স্থানীয় পারভেজ মোল্লা জানান, আমাদের এলাকার সাধারণ মানুষ ডাকাত জসিমের ভয়ে ভীত। কখন কার উপর আক্রমণ করে বসে কেউ বলতে পারেনা। তাই খুব দ্রুত ডাকাত জসিমের বিরুদ্ধে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য প্রশাসনের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।
জাজিরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান জানান, আমরা ঘটনার দিন রাতেই দুইজনকে আটক করেছি। বাকিদেরকেও আটক করার চেষ্টা চলছে, বিশেষ করে ডাকাত সরদার জসিম মোল্লাকে আটক করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। খুব শিঘ্রই তাকে আটক করতে সক্ষম হবো বলে আমরা আশা করি।