২০১৯ সালের কোন এক দিনের ১২টা। কোভিড-১৯ নামক এক মহামারীর ভয়ে পুরো বিশ্ব ঘরবন্দী। কোনোরকম জরুরি সেবাগুলো চালু আছে। আর আছে অপেক্ষারত মিডিয়া। ব্রিফিং হবে করোনার আপডেট নিয়ে। মিডিয়া তা জানবে, পৌঁছে দেবে পুরো দেশের কাছে। ব্রিফিংয়ের দায়িত্বে আছেন শাড়ি পরিহিতা এক নারী, নাম মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। তিনি একজন ডাক্তার, একজন অধ্যাপকও।
করোনা আক্রমণের কারণে দেশের মানুষের কাছে অতি পরিচিত নাম সেব্রিনা ফ্লোরা। সুন্দর বাচনভঙ্গী, আশ্চর্যরকমের শান্ত ব্যক্তিত্ব সেই সঙ্গে নামের স্বকীয়তা, আত্মবিশ্বাস, শিক্ষাগত যোগ্যতা আর কাজের অভিজ্ঞতা তো আছেই। বর্ণিল এক শিক্ষা এবং কর্মজীবন তার। তবে জন্ম খুব সাধারন এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। প্রাথমিক, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়ে ১৯৮৩ সালে ভর্তি হন ঢাকা মেডিকেল কলেজে। ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকার দারুন নেতৃত্বের সহজাত গুণাবলীও রপ্ত করে নেন খুব দ্রুত। ডর্মেটরিতে তার কাটানো দিনগুলো তাকে শিখিয়েছিল স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থেকেও পালে কী করে হাওয়া লাগাতে হয়!
এমবিবিএস শেষ করেই বেশ কিছু জায়গায় খণ্ডকালীন হিসেবে কাজ করেন তিনি। ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশাল মেডিসিন থেকে রোগতত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেন। বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিলে সহকারী পরিচালক হিসেবে ৩ বছর গবেষণা করেন। এরপর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশাল মেডিসিনে। ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ থেকে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করে ইন্সটিটিউট অব এপিডেমিয়োলোজি ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড রিসার্চের পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হোন ২০১৬ সালে। ফাউন্ডেশন ফর অ্যাডভান্সমেন্ট অব ইন্টার্ন্যাশনাল মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চের একজন সম্মানিত ফেলো তিনি। এ ছাড়া ইন্টার্ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব দ্য ন্যাশনাল পাবলিক হেলথ ইন্সটিটিউটের সহ-সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেয়েও থেমে থাকেননি তিনি। দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মহামারী সৃষ্টিকারী ভাইরাস ও রোগ বিস্তার প্রতিরোধে নানারকম গবেষণা ও বিভিন্ন নিরাপত্ত্বা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ঢাকার শাহজালাল বিমানবন্দরে জিকা ভাইরাস নিয়ে একবার বেশ গুঞ্জন উঠেছিল, তো মনে আছে নিশ্চয়ই! তার তত্ত্বাবধানে ছিলেন এই সেব্রিনা ফ্লোরা। এ ছাড়া ২০১৭ সালে তার দল বাংলাদেশে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে কাজ করে। আর ২০১৯ আর ২০২০ সালে করোনা ভাইরাসের বৈশ্বিক মহামারী প্রতিরোধে তার পদক্ষেপই তাকে চিনিয়েছে দেশের কাছে।
এই এতসব গুরুত্বপুর্ণ বিষয় তিনি সামাল দিয়েছেন একা হাতে, নিরলসভাবে। ডা. মীরজাদী ফ্লোরার এই ভূমিকা এবারই প্রথম নয়। এর আগে বিভিন্ন দুর্যোগে তিনি এগিয়ে এসেছেন সাহসের সঙ্গে। মানুষের কাছে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি হিসেবে তুলে ধরেছেন বার্তাগুলো। তবে এই করোনাকালীন তার নিয়মিত উপস্থিতিই তাকে এই প্রথম এত আলোচনায় এনেছে।
বর্তমানে তিনি আইসিউতে আছেন। শারীরিক নানা জটিলতা নিয়ে সিঙ্গাপুরে হাসপাতালে ভর্তি হোন তিনি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাইয়ের শেষের দিকে কক্সবাজারে গিয়ে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। এরপর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অবস্থার অবনতিতে চলতি মাসের ৭ আগস্ট সিঙ্গাপুরে নেওয়া হয় তাকে। মূলত অগ্ন্যাশয় ও পিত্তথলির কার্যকারিতা ঠিক রাখতে একটি অস্ত্রোপচার হয়। এরপরেই দেখা দেয় কিডনিতে জটিলতা। ডায়ালাইসিস চলাকালীন হার্টের সমস্যা বেড়ে যাওয়ায় তাকে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়।
তিনি বেঁচে আছেন। বেঁচে থাকুক আমাদের মাঝে। দেশের ক্রান্তিকালে সময়ের সাহসী সন্তান হয়ে যিনি অভয়ের বানী ছড়াতেন, তার অসুস্থতায় মৃত্যুর গুজব ছড়ানো কতটা ঠিক, উত্তরবিহীন প্রশ্ন থাকলো।