বুধবার, ০৬ অগাস্ট ২০২৫, ০২:৩৯ অপরাহ্ন

গণঅভ্যুত্থানের পথ ধরে নতুন বাংলাদেশ

Reporter Name / ৩৯ Time View
Update : মঙ্গলবার, ৫ আগস্ট, ২০২৫, ৭:১১ পূর্বাহ্ন

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ৩৬ দিনের দেশকাঁপানো গণআন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল ওই বছরের ১ জুলাই। অহিংস এ আন্দোলন সহিংস হয় ১৫ জুলাই থেকে। পরে তা রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। একপর্যায়ে ক্ষমতা ও দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিজয়ের উল্লাসে লাখো মানুষ জড়ো হন গণভবন এলাকায়। ছাত্র-জনতার সেই বিজয়ের প্রথম বর্ষপূর্তি আজ ৫ আগস্ট মঙ্গলবার।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে টানা সাড়ে ১৫ বছরের স্বৈরশাসনের অবসান ঘটে। স্বাধীন বাংলাদেশে ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর আরেকটি গণঅভ্যুত্থানের সাক্ষী হন দেশবাসী। তবে ২০২৪-এর গণআন্দোলনে মূল্য দিতে হয়েছে অনেক বেশি। ৩৬ দিনের আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন ১৪০০ জন (সরকারি তথ্যে ৮৪৪ জন) এবং আহত ও পঙ্গু হয়েছেন ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। এর আগে দেড় দশকের শাসনামলে হাজারো মামলায় লাখ লাখ মানুষ কারাবন্দি হয়েছেন। গুম, হত্যার শিকার হয়েছেন অগণিত মানুষ। তিন-তিনটি বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে হরণ করা দেশের গণতন্ত্র ও মানুষের বাকস্বাধীনতা। আর এমন পরিস্থিতিতে অনিবার্য ওই অভ্যুত্থানে অনেক মানুষকে জীবন দিতে হয়েছে।
শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে ভোটাধিকার ও বাকস্বাধীনতা হরণ, মানবাধিকার লঙ্ঘন, ব্যাপক দুর্নীতি ও অর্থ পাচার, দেশকে ভারতের তাঁবেদারি রাষ্ট্রে পরিণত করা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা, ঋণের নামে ব্যাংক লুট, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ অনেক অভিযোগ রয়েছে। এসবের বিপরীতে তিনি ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন বড় বড় অবকাঠামো ও উন্নয়ন প্রকল্পের নামে অর্থনৈতিক উন্নতির গল্প, সাজাতেন জঙ্গি নাটক। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েই ছিল। সেটার বহিঃপ্রকাশ ছিল শুধু সময়ের অপেক্ষা। উপলক্ষ্য তৈরি করে দেয় সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন।
কোটা সংস্কার আন্দোলন লাগাতার শুরু হয় গত বছর ১ জুলাই। গত বছর ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ‘রাজাকার’ সংক্রান্ত এক বক্তব্যের পর তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান শিক্ষার্থীরা।
সেদিন রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোয় হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী বেরিয়ে এসে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন- ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার; কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার।’ এর আগে দেশে সাড়ে ১৫ বছরে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলার সাহস পায়নি কেউ। নির্যাতনমূলক আইন, গুম, খুন, আয়নাঘর, গণগ্রেপ্তার, হয়রানি ও চাপের মুখে নাগরিক সমাজ এবং গণমাধ্যমও ছিল কোণঠাসা। এই প্রথম শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনার মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে শুরু হয় কোটা সংস্কার আন্দোলনের নতুনযাত্রা।
গত বছর ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের দিন ছাত্রলীগকে নামিয়ে দেওয়া হয় শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে। ওইদিন এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ স্লোগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে। তারা প্রস্তুত। এরপরই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর ব্যাপকভাবে হামলা চালায়। ছাত্রীদেরও ধরে ধরে পেটানো হয়। গুলি করা হয় শিক্ষার্থীদের লক্ষ করে। ১৬ জুলাই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে খুব কাছ থেকে গুলি করে খুন করে পুলিশ। সেই ভিডিওচিত্র ভাইরাল হয়ে জ্বলন্ত বারুদের মতো কাজ করে। দেশজুড়ে শুরু হয় বিক্ষোভ। বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ এবং স্লোগান দেয়- ‘বুকের ভেতর অনেক ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর।’
সাধারণ মানুষও ভাবতে পারেননি, কয়েকদিনেই ২০০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলা হবে। কেউ হয়তো ভাবতে পারেননি, ঘরের মধ্যে থাকা শিশু, ছাদে থাকা কিশোরী, বারান্দায় থাকা মানুষ গুলিতে নিহত হবেন। যদিও ১৯ জুলাই কারফিউ জারি করার বিষয়টি জানিয়ে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘শুট অন সাইট’ বা দেখামাত্র গুলির নির্দেশ জারি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো, কলেজ শিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো, স্কুল শিক্ষার্থীদের গুলি করে মারা হলো। মায়েরা কাঁদলেন, বাবারা কাঁদলেন, সহপাঠীরা কাঁদলেন। ক্ষোভে ফুঁসে উঠল দেশ। একে একে শিক্ষক, অভিভাবক, আইনজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক, সংস্কৃতিকর্মী, সাংবাদিক, অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা সমর্থন জানাতে শুরু করলেন শিক্ষার্থী ও তরুণদের আন্দোলনে।
শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ৯ দফা দাবি জানিয়েছিলেন। সেই দাবি পূরণের বদলে বেছে নেওয়া হয় নির্যাতন ও গণগ্রেপ্তারের পুরোনো পথ, যা শেখ হাসিনা তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ১৫ বছর ধরে প্রয়োগ করেছেন। কয়েকদিনের মধ্যে ১০ হাজারের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। বাদ যায়নি এইচএসসি পরীক্ষার্থীরাও। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ, আবু বাকের মজুমদার ও নুসরাত তাবাসসুমকে তুলে নিয়ে আটকে রাখা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) কার্যালয়ে। সেখান থেকে জোর করে আন্দোলন প্রত্যাহারের ভিডিও বার্তা দেওয়ানো হয়।
ছাত্র-জনতার প্রতিবাদ এবং সমন্বয়কদের অনশনের মুখে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। ২০২৪ সালের ২ আগস্ট ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে ৯ দফা দাবিকে ১ দফায় রূপান্তর করা হয়। বলা হয়, সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে। ওইদিকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী জনগণের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন শুধু মাঠে আওয়ামী পুলিশ। শেখ হাসিনা শেষ চেষ্টা হিসেবে নামিয়ে দেন তার রাজনৈতিক শক্তিকে। ৪ আগস্ট ঢাকার রাস্তায় এবং দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায়। হামলাকারীদের কারো কারো হাতে ছিল অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র, অনেকের হাতে ছিল দেশীয় অস্ত্র। ওইদিন সংঘর্ষে নিহত হন অন্তত ১১৪ জন মানুষ।
যদিও ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে আওয়ামী লীগ বেশি সময় রাজপথে টিকতে পারেনি। ওইদিনই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ গণযাত্রার ডাক দেওয়া হয়। এ কর্মসূচির দিন সকালে কয়েকটি জায়গায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষ হয়। দুপুর নাগাদ স্পষ্ট হয়ে যায়, সরকার নড়বড়ে হয়ে গেছে। বেলা আড়াইটায় হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা একটি সামরিক হেলিকপ্টারে তার বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে উড্ডয়ন করেন। তিনি ভারতের আগরতলা হয়ে দিল্লি যান।
দুপুর সোয়া ১টায় আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান জনগণের উদ্দেশে বক্তব্য দেবেন। তখনই মানুষ বুঝে যায়, পট বদলে যাচ্ছে। মানুষ একে একে ঘর থেকে বের হতে শুরু করে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী রাস্তায় মানুষকে আর বাধা দেয়নি। বেলা আড়াইটায় শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালানোর খবরের পর লাখো মানুষের মিছিল, স্লোগানে মুখর হয় ঢাকা। দুপুরের দিকে জনস্রোত গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়ে। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। অনেকে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে শোকরানা নামাজ পড়তেও দেখা গেছে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও বাংলাদেশের মানুষ ২০২৪-এর জুলাইয়ের মতো এত মৃত্যু দেখেনি। অতীতের আন্দোলনের মতো এবারের আন্দোলনেও সামনের সারিতে ছিলেন শিক্ষার্থীরা। এবারের বিশেষ দিক ছাত্রীদের, নারীদের বড় অংশগ্রহণ। আরেকটি দিক হলো, এবার লড়াই হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। বেশিরভাগ টেলিভিশন চ্যানেল যখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে, অনলাইন মাধ্যমগুলো চাপে, তখন শিক্ষার্থীদের যোগাযোগ ও আন্দোলনের আদর্শিক লড়াইয়ের পথ হয়ে ওঠে ফেসবুক, টুইটার। সেখানে ছড়িয়ে পড়ে বিক্ষোভ, স্বজন হারানোর বেদনা, পুলিশের গুলি করার ভিডিও চিত্র। তাতে যুক্ত করা ছিল মুক্তিযুদ্ধের গান, দেশপ্রেমের গান। নতুন নতুন স্লোগান, দেয়াললিখনও তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বে ছিল ‘জেনারেশন জেড’, যারা সংক্ষেপে ‘জেন জি’ নামে পরিচিত। তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ এ প্রজন্ম তাদের লড়াই তাদের মতো করে করেছে। তাদের ঠেকাতে বারবার ইন্টারনেট বন্ধ করা হয়েছে। কখনো কখনো ইন্টারনেট চালু থাকলেও বন্ধ রাখা হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। তবে শিক্ষার্থীদের দমানো যায়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের ৩৪ বছর পর আরেকটি গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে একটি ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটল এবং বড় রক্তপাতের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ পেল দেশবাসী।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category
Theme Created By ThemesDealer.Com